১৭ মার্চ আজ। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির
পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৩ তম জন্মদিন। ১৯২০ সালের এই দিনে
গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় সম্ভ্রান্ত শেখ পরিবারে তার জন্ম। জাতি দিনটিকে
'জাতীয় শিশু দিবস' হিসেবে উদযাপন করবে।
দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়। আজ সরকারি ছুটি। সরকারি-বেসরকারি
পর্যায়ে নানা কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। এবারে দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে,
'স্বাধীনতার চেতনায় মোরা গড়বো দেশ/বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ'। বাঙালির
অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমানের কর্ম ও রাজনৈতিক জীবন অসামান্য গৌরবের। স্কুলজীবনেই রাজনীতিতে
জড়িয়ে পড়েন তিনি। কৈশোরে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র
থাকাবস্থায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদানের
কারণে প্রথমবারের মতো
কারাবরণ করেন। ম্যাট্রিক পাসের পর কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়নকালে হোসেন
শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকসহ তৎকালীন প্রথম সারির
রাজনৈতিক নেতাদের সানি্নধ্যে আসেন তিনি। ওই সময় থেকে নিজেকে ছাত্র ও
যুবনেতা হিসেবে রাজনীতির অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত করেন।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের পরপরই ঢাকায় ফিরে নতুন
রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা নিয়ে অগ্রসর হন তিনি। সহকর্মীদের নিয়ে ১৯৪৮ সালে
ছাত্রলীগ গঠন করেন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন তৎকালীন ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের
বিরুদ্ধে পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল 'আওয়ামী মুসলিম লীগ' গঠিত হলে তরুণ
নেতা শেখ মুজিব দলটির যুগ্ম সম্পাদক নিযুক্ত হন। পরে অসাম্প্রদায়িক চেতনায়
আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দিয়ে দলের নামকরণ করা হয়
আওয়ামী লীগ।
বঙ্গবন্ধু বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে পাকিস্তানি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে
প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এসব আন্দোলনের
কারণে বারবার কারাগারেও যেতে হয় তাকে।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় তাকে।
আওয়ামী লীগ প্রধান হিসেবে ১৯৬৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি লাহোরে তৎকালীন পূর্ব
পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন তথা বাঙালির মুক্তির সনদ ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা
করেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুসহ
নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নামে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করে তাদের কারাগারে
পাঠান। ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাঙালি শেখ মুজিবকে
কারামুক্ত করে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধি দিয়ে সম্মানিত করে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালি বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার পক্ষে অকুণ্ঠ সমর্থন
জানায়। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের ম্যান্ডেট লাভ করে আওয়ামী
লীগ; কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির এ
নির্বাচনী বিজয়কে মেনে নেয়নি। এরপর বঙ্গবন্ধু স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে
নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে প্রথমে স্বাধিকার আন্দোলন এবং চূড়ান্ত পর্বে
স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ দেন।
এ আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় একাত্তরের মার্চে নজিরবিহীন অসহযোগ
আন্দোলন শুরু করেন বঙ্গবন্ধু। ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমানে
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসমুদ্রে ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন,
'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার
সংগ্রাম'। এ ভাষণে সেদিন স্বাধীনতার ডাক দিয়ে ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতিকে
স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকনির্দেশনা দেন তিনি।
একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর
আক্রমণ শুরু করলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর
রোডের বাসভবন থেকে ওয়্যারলেসে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এরপর বঙ্গবন্ধুকে তার
বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। ৯ মাসের
সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বীর বাঙালি একাত্তরের ১৬
ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রের অধিকারী হয়।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে স্বদেশে ফিরে এসে স্বাধীন
দেশের পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন কাজে আত্মনিয়োগ করেন তিনি। ১৯৭৫ সালে জাতির
অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেন তিনি। এর কিছুদিনের
মধ্যেই ১৫ আগস্টের ভোররাতে নিজ বাসভবনে ক্ষমতালোভী ঘাতকদের হাতে সপরিবারে
স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর জীবনাবসান ঘটে।
স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অবিস্মরণীয় ভূমিকার জন্য
তিনি সারাবিশ্বে সমাদৃত। অসামান্য অবদানের জন্য 'জুলিও কুরি' পদকে ভূষিত হন
তিনি। এ ছাড়া বিবিসির এক জরিপে বঙ্গবন্ধু সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি
নির্বাচিত হন।
জাতির জনকের জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর
রহমান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন। পৃথক বাণীতে জাতির জনকের
স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার শপথ
নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান তারা।
কর্মসূচি : সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর
সমাধিবেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবেন। সেখানে ফাতেহা পাঠ ও বিশেষ মোনাজাতে
অংশ নেবেন তিনি। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী সমাধিসৌধ কমপ্লেক্সের পাবলিক
প্লাজায় গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসন, বাংলাদেশ শিশু একাডেমী ও গোপালগঞ্জ শিশু
একাডেমী আয়োজিত শিশু সমাবেশ, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান
অতিথির ভাষণ দেবেন। বিকেলে গণভবনে শিশু একাডেমীর উদ্যোগে শিশু সমাবেশ ও
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান
অসুস্থ হয়ে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন থাকায় এবার দিবসের কর্মসূচিতে যোগ দিতে
পারছেন না।
বাংলাদেশ টেলিভিশন, বেতারসহ বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে বিশেষ
অনুষ্ঠানমালা প্রচার এবং সংবাদপত্রগুলোতে বিশেষ ক্রোড়পত্র ও নিবন্ধ প্রকাশ
করা হবে। বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদসহ বিভিন্ন মসজিদে পবিত্র কোরআনখানি,
মোনাজাত, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল এবং মন্দির, গির্জা, প্যাগোডাসহ অন্যান্য
ধর্মীয় উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনা সভা হবে।
এ উপলক্ষে তথ্য মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, ধর্ম মন্ত্রণালয়,
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, বাংলা একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমী, নজরুল ইনস্টিটিউট
ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে।
আওয়ামী লীগের দু'দিনের কর্মসূচিতে রয়েছে_ আজ সকালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে
বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে জাতির পিতার প্রতিকৃতি ও ১০টায় টুঙ্গিপাড়ায়
বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দলের শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ এবং
আগামীকাল সোমবার বিকেল ৩টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা। প্রধান অতিথি
হিসেবে যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ ছাড়া ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগসহ বিভিন্ন সংগঠন দিবসটি উপলক্ষে কর্মসূচি পালন করবে।